রাজনীতি মহান। রাজনীতি ছাড়া একটি দেশ যেমনভাবে চলতে পারেনা তেমনি একটি দেশকে রাজনীতি ছাড়া প্রশাসনিক সু-বিন্যস্ত করাও সম্ভব হয় না। তাই রাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। একটি সরকার স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে আর সেই সরকারকে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে, জনগনের স্বার্থে আন্দোলনের মা্ধ্যমে অপসারণ করা সর্বোস্তরের
জনগণের কর্তব্য হয়ে দাড়ায়। কেউ এর থেকে পিছিয়ে থাকা কাম্য হতে পারেনা্। এখানেই রাজনীতির বড় ভূমিকা রাখতে হয় বা রাজনীতি হয়ে উঠে অপরিহার্য্ বিষয়। কারণ আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন হয় সু-সংগঠিত একটি জনগোষ্ঠী যা কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ছাড়া অসম্ভব।
রাজনীতি নিয়ে আর্টিক্যাল লিখা আমার মূখ্য বিষয় নয়, আমার লিখার মূল বিষয় হলো রাজনৈতিক প্রার্থীদেরকে নিয়ে, যাদের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে, আবার তারাই সরকার গঠন করে থাকে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই হয়ে উঠেন জনপ্রতিনিধি। তারাই জনগণের বিচার করে, সামাজিক বিভিন্ন সংঘাত তাদের ইশারাতেই সমাধান হয়ে থাকে বা কিছু কিছু সময় তাদের মূর্খতার কারণে সমাধানের পরিবর্তে বিশালাকারে দাঙ্গা বাজতেও সময় নেয় না।
একজন জনপ্রতিনিধির যেভাবে তাঁর ন্যূনতম সামাজিক মূল্যবোধ থাকা কর্তব্য সেভাবে সমাজের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাও একটি অতীব জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে একজন জনপ্রতিনিধির ন্যূনতম শিক্ষাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারণ এ কথা স্পষ্ট যে, জনগণের আস্থা বা জনপ্রতিনিধির সামাজিক মূল্যবোধ আদ্যো-পান্তভাবেই শিক্ষার উপর নির্ভর করে থাকে। তাই সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নির্বাচন কমিশনের উচিৎ শুধু জনগণের স্বার্থে নয় বরং জনপ্রতিনিধিদের স্বার্থেই শিক্ষা সংক্রান্ত একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা।
আজকের আর্টিক্যালটি লিখতে যিনি আমাকে বেশী উদ্ভুদ্ধ করেছেন তিনি হলেন আমাদেরই পৌরসভার নব নির্বাচিত একজন প্রভাবশালী মেয়র (রাজনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষার্থে নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না)। এই লোকটি মনে হয় না জীবনে কখনও কোন বিদ্যালয় বা কোন মাদ্রাসার আঙ্গিনা ঘেষেছেন। বাংলার বহুল পরিচিত বা প্রচলিত ভাষা অনুযায়ী যিনি নিজের নামখানা লিখতেই অন্তত তিনটি কলম ভেঙ্গে ফেলেন। তার মূর্খতা বুঝাতে ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলে জিনিসটা হয়তো ক্লিয়ার করতে পারবো্। ২০১১, বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেট বিশ্বর সবচেয়ে বড় আসর ধুন্ধুমার বিশ্বকাপ ক্রিকেট। স্বাগতিক বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ডের সাথে তাই আগেই টিকেট সংগ্রহ করে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলাম আমি, আমাদের বর্তমান মেয়রসহ আরও অনেকে। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিল ইংল্যান্ড। স্পষ্ট মনে নেই, সম্ভবত ‘জোনাথন ট্রট’ আউট হয়েছিলেন তাই তিনি ড্রেসিং রুমের পথ ধরলেন সাথে নন-স্ট্রাইক প্রান্তের ব্যাটসম্যন যিনি ছিলেন তিনিও জোনাথন ট্রটের সাথে বাউন্ডারী সীমানার কাছে এসে পৌঁছালেন পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে স্বাগত জানিয়ে নিতে। আমরা কম আর বেশ যারা ক্রিকেট নিয়ে মোটামুটি গবেষণা করি বা ক্রিকেট খেলা দেখি তারা সবসময়ই এই জিনিসটি দেখেন, বুঝেন যে নন-স্ট্রাইক প্রান্তের ব্যাটসম্যানরা প্রায়ই পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে রিসিভ করে নিয়ে যায়। মজার বিষয় হলো জোনাথন ট্রটের সাথে পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে রিসিভ করতে আসা নন-স্ট্রাইক প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে এক সাথে বাউন্ডারী লাইনের দিকে আসতে দেখে আমাদের সম্মানিত মেয়র সাহেব সবার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিল, কি ব্যপার! দুইজন আউট হয়ে গেল নাকি? প্রশ্ন শুনে সবইতো থ! একি কয়!
বুঝতে চেষ্টা করুন বাংলাদেশের মত একটি ক্রিকেট জনপ্রিয় দেশে যদি একজন মানুষের এইরকম বোধোদয় হয় তাহলে তার মূর্খতার পরিচয় দিতে আর কোনো বিশেষণ ব্যবহার করতে হবে বলে মনে হয়না। আজ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাজনীতিতে আসতে চায় না। কারণ একটাই, তা হলো শিক্ষা। কার পিছনে রাজনীতি করবে, কাকে স্যার বা বস বলে সম্বোধন করবে যে কি না শুদ্ধভাবে নিজের নামটুকুই লিখার যোগ্যতা রাখেনা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজারও উচ্চ শিক্ষিত যুবক চাকুরির অভাবে বেকার সময় কাটাচ্ছে। চাকুরির জন্য কার কাছে যাবে, কার কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা চাইবে, যে কি না শিক্ষিত জনসমাজের মূল্যই অনুধাবন করতে পারেনা। প্রচলিত বা কাগজে কলমে লিখিত ধারা এটাই যে আপনার যোগ্যতা আছে আপনি কেন চাকুরি পাবেন না! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্য, এটাই স্পষ্ট যে আজ-কাল মামু-খালু বা লবিং ছাড়া চাকুরির প্রত্যাশা করার চেয়ে সোনার হরিণের প্রত্যাশা করা আরও বেশী শ্রেয়তর। যদি সাধারণ একটি গাড়ী চালক পদে চাকুরির প্রত্যাশীর জন্য শিক্ষা সংক্রান্ত শর্তে শার্তায়িত করা হয় তাহলে একজন জনপ্রতিনিধি যে কি না সমাজের নেতৃত্ব দিবে তার জন্য কেন ন্যূনতম শিক্ষার শর্ত থাকবেনা?
দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সংগঠন সচিবালয়। সচিবালয় কর্তৃক প্রতিটি তন্ত্র বা নীতিই হলো আমলাতন্ত্র। যদিও আমলাতন্ত্র আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য আধুনিকতার সোপান। পক্ষান্তরে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্যতা কখনও কাম্য হতে পারে না। আমলারা উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ বেতনভোগী সরকারি কর্মচারী, যেখানে বিসিএস ক্যাডারের ছড়াছড়ি। তাঁরা সাধারণত অভিজাত শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। সর্বদা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কার্যালয়েে আয়েশী জীবন-যাবন করে, বড় বড় কোটিপতিদের সাথে উঠা বসা করে তারা কিভাবে অনুধাবন করবে দেশের প্র্ত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সর্বোস্তরের জনসাধারণের চাহিদা, আকাঙ্খা সম্পর্কে। অথচ আজ প্রতিটি মন্ত্রণালয়েই সংশ্লিষ্ট সচিব বা আমলারাই ঐ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত যে কোন নীতির খসড়া প্রদান করে থাকেন আর মাননীয় মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আনুষ্ঠানিকতা সারাতে সেটাতে সাইন করে আইনে পরিণত করে দেন। মন্ত্রণালয়গুলো অতিমাত্রায় আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয় কারণ একজন মন্ত্রণালয় নির্বাহীর একক প্রচেষ্টায় একটি আইন প্রণয়ন করার যোগ্যতা রাখেন না স্বল্প শিক্ষার অধিকারী বিধায়। সে ক্ষেত্রে আমলারাই হয়ে উঠে সর্বেসর্বা যার ফলে লাল ফিতার দৌরাত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে যা দেশের প্র্শাসনিক ব্যবস্থার জন্য মারাত্নক হুমকি হয়ে দাড়ায়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিৎ এখনি দেশের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের প্রার্থীতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাকে প্রার্থীর প্রধান যোগ্যতাবলে চিহ্নিত করা। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড মেম্বার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রার্থীর প্রধান যোগ্যতা হিসাবে শিক্ষা সংক্রান্ত একটি শর্ত সংযোজন করা যেতে পারে।
শিক্ষা সংক্রান্ত রূপরেখাটি হতে পারে এরূপ:-
১। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ওয়ার্ড মেম্বার পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
২। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে তিনজন করে মহিলা মেম্বার থাকে যাদের প্রত্যেককে অবশ্যই মাধ্যমিক পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
৩। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতক পাশ সনদ দাখিল করতে হবে। পাশাপাশি ওয়ার্ড প্রসেসিং এবং ডাটা এন্ট্রিসহ কম্পিউটার চালানোতে দক্ষ হতে হবে।
৪। প্রতিটি পৌরসভা মেয়র পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
৫। প্রতিটি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতক পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
৬। প্রতিটি উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
৭। প্রতিটি সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
৮। প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন মেয়র পদপ্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর পাশ সনদ দাখিল করতে হবে।
৯। যেহেতু আমাদের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজের পছন্দের লোকদেরকেই কেবিনেটে জায়গা দিয়ে থাকেন বা কেবিনেট মেম্বার নির্বাচন করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হতে পারে সংশ্লিষ্ট বিভাগে স্নাতকোত্তর পাশ ডিগ্রিধারী ব্যাক্তিকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী হিসাবে নির্বাচন করা এবং প্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞাত ব্যক্তিদেরকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
উল্লিখিত আমার রূপরেখাটি সার্বজনীন নাও হতে পারে। তা অবশ্যই সমালোচনারযোগ্য বলেও আমি বিশ্বাস করি। তবে সমালোচনা হতে হবে গঠনমূলক অবশ্যই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। কারণ শিক্ষা ছাড়া একটি জাতি কখনও সভ্যতার শিখরে পৌঁছাতে পারেনা তাই শিক্ষাকে কোনভাবেই পাশ কেটে যাওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান আমেরিকা ইউরোপসহ উন্নত দেশ সমূহের প্রত্যেকটি দেশেই প্রার্থীদের প্রধান যোগ্যতা চিহ্নিত করতে শিক্ষা সম্পর্কিত সু-নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সুতরাং আমরা এখনও উন্নত না হলেও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নাগরিকতো বটে, তাহলে আমরা কেন শিক্ষার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীন রেখে পিছনে পড়ে থাকবো?
No comments:
Post a Comment